নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়

স্থাপিত-১৯৭২ ইং,

EIIN NO- 109244, বিদ্যালয় কোডঃ২৩৭০, উপজেলা কোডঃ১৪১, জেলা কোডঃ১৪

গ্রাম ও পোস্টঃ নরোত্তমপুর, উপজেলাঃ কাপাসিয়া, জেলাঃ গাজীপুর।

নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় : ইতিহাস, অবদান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

শিক্ষা হলো মানব জীবনের মূল চালিকা শক্তি। একটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ নির্ভর করে তার শিক্ষার মান ও বিস্তৃতির উপর। গ্রামীণ জনপদে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বিদ্যালয়গুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিত: ১৯৭২ ইং) এমনই এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা স্থানীয় মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং উন্নতির ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে।

বিদ্যালয়ের EIIN নং ১০৯২৪৪, বিদ্যালয় কোড ২৩৭০, উপজেলা কোড ১৪১ এবং জেলা কোড ১৪। গ্রাম ও পোস্ট নরোত্তমপুর, উপজেলা কাপাসিয়া, জেলা গাজীপুর—এই পরিচয়ে বিদ্যালয়টি আজ শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও সমাদৃত।


প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সারা দেশে শিক্ষা বিস্তারের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে গাজীপুর জেলার গ্রামীণ জনপদগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল। স্থানীয় জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রতি একান্ত আগ্রহ থাকলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত না।

এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ ও সমাজের সচেতন মানুষরা একত্রিত হয়ে গ্রামের শিশু-কিশোরদের জন্য একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দীর্ঘ আলোচনা, অর্থ সংগ্রহ এবং স্থানীয় জমিদাতাদের সহায়তায় ১৯৭২ সালে “নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে এলাকার শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।


ভৌগোলিক অবস্থান

বিদ্যালয়টি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামে অবস্থিত। গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টির চারপাশে সবুজ প্রকৃতি, গাছপালা ও মুক্ত বাতাস শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেছে। এর অবস্থান এমন যে, আশেপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরাও এখানে সহজেই আসতে পারে। ফলে বিদ্যালয়টি একটি আঞ্চলিক শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা

প্রতিষ্ঠাকালে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ছিল খুবই সীমিত। মাত্র কয়েকটি টিনশেড কক্ষ দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভূমিতে স্থায়ী ভবন গড়ে উঠেছে।

  • ভবন সংখ্যা: আধুনিক শ্রেণিকক্ষ সম্বলিত বহু তলা ভবন।

  • গ্রন্থাগার: শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের জন্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে।

  • ল্যাবরেটরি: বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের জন্য পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।

  • কম্পিউটার ল্যাব: ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে এখানে কম্পিউটার ল্যাব চালু হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শিখছে।

  • খেলাধুলার মাঠ: শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশের জন্য প্রশস্ত খেলার মাঠ রয়েছে।


শিক্ষকমণ্ডলী

বিদ্যালয়ের মূল শক্তি হলো এর নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকবৃন্দ। নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বদা আন্তরিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান প্রদান করে থাকেন। তাঁদের নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি বর্তমানে উপজেলার অন্যতম মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।


পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাগত কার্যক্রম

বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাঠদানের সুযোগ রয়েছে।

  • নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি সহপাঠ কার্যক্রম যেমন বিতর্ক, কুইজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞান মেলা আয়োজন করা হয়।

  • বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

  • বিদ্যালয়ে স্কাউট ও গার্লস গাইড কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও সামাজিক সেবার মানসিকতা গড়ে তোলে।


ফলাফল ও কৃতিত্ব

নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল করে আসছে। শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন অলিম্পিয়াডেও তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে।

বিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খাতে—শিক্ষা, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায়ে—সাফল্যের সাথে কাজ করছেন, যা বিদ্যালয়ের জন্য গৌরবের বিষয়।


সামাজিক ভূমিকা

বিদ্যালয়টি শুধু শিক্ষাদানেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি স্থানীয় সমাজজীবনেরও একটি অপরিহার্য অংশ।

  • গ্রামের মানুষদের সামাজিক অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের অন্যতম কেন্দ্র এই বিদ্যালয়।

  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জাতীয় সংকটের সময় বিদ্যালয় ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

  • স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে।


চ্যালেঞ্জ

যদিও বিদ্যালয়টি অনেক দূর এগিয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে:

  • পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব।

  • আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা।

  • গ্রামীণ এলাকার কিছু পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া।


উন্নয়নের সম্ভাবনা

সরকারি-বেসরকারি সহায়তা এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা পেলে বিদ্যালয়টি আরও এগিয়ে যেতে পারে।

  • ডিজিটাল ক্লাসরুম ও স্মার্ট লার্নিং ব্যবস্থা চালু করলে শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে।

  • প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি শক্তিশালী অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হলে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

  • প্রযুক্তি, কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ সংযুক্ত করা গেলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানে আরও যোগ্য হয়ে উঠবে।


ভবিষ্যৎ ভিশন

নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষালয় নয়, বরং একটি স্বপ্ন। আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক করে তোলাই এর মূল লক্ষ্য। বিদ্যালয়ের ভিশন হলো—

  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা।

  • আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবিক শিক্ষার সমন্বয়ে একটি সুষম প্রজন্ম তৈরি করা।

  • কাপাসিয়া উপজেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্থান করে নেওয়া।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বিস্তারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এটি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সমাজের উন্নয়ন, সংস্কৃতি চর্চা ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনের কেন্দ্র। ভবিষ্যতে সঠিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যালয়টি দেশের একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে।

নরোত্তমপুর উচ্চ বিদ্যালয় তার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণের জন্য গর্বের প্রতীক। বলা যায়, এই বিদ্যালয় শুধু জ্ঞান নয়, স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও আলোর দিশারী।

Scroll to Top